শুরু করি একটা সত্য ঘটনা দিয়ে । সিডনীর এক বাঙালি পরিবারে ঘটে যাওয়া ঘটনা।
মিলির (ছদ্মনাম) বাচ্চার বয়স যখন ১৩ মাস, হটাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলো ও। কপাল ভালো ঘটনাটা ঘটে ছুটির দিন, তাই শোয়েব (ছদ্মনাম) বাসায় ছিলো। দ্রুত মিলিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তারি পরীক্ষায় মিলির উচ্চ রক্তচাপ পাওয়া গেলো। কিছু সিম্পটম চোখে পড়ায় তাকে দুটো ছোট্ট প্রশ্ন করলো ডাক্তার :
১) তোমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ কি?
২) শেষ কবে তুমি তোমার প্রিয় কাজটি করে আনন্দ পেয়েছো?
মিলি আঁটকে গেলো দ্বিতীয় প্রশ্নে, মনে করতে পারলো না শেষ কবে ও একটা পুরো সিনেমা এক বসায় দেখেছে ! স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে পেলো, বাচ্চা পেটে থাকতে শোয়েবের সাথে হলে গিয়ে দেখেছিলো সিন্ডারেলা! ও হ্যাঁ... ঐটাই তো। তার মানে প্রায় ১৬ মাস ধরে কোনো মুভি দেখা হয়নি আর! অথচ মিলি প্রতি সপ্তাহেই মুভি দেখতো আগে.. বাংলা ইংরেজি হিন্দি... কতো কি!
ডাক্তারের যা বোঝার তা সে বুঝে গেলো। একটা ফরম এগিয়ে দেয়া হলো মিলির দিকে। কিছু প্রশ্ন আছে ওতে। মিলির উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করে যা বের হয়ে আসলো, তা হলো বাচ্চা নিয়ে মিলি ভয়ঙ্কর রকমের অবসেসড, এই অবসেশন থেকে ইনসোমনিয়া, স্ট্রেস, এংজাইটি এবং সর্বশেষ ফলাফল ভয়াবহ ডিপ্রেশন। ঘটনা পুরা একটা সিরিজের মতো। প্রেশার কুকারে তেলের পরে পেঁয়াজ, এরপর আদা , রসুন , জিরা, মরিচ কষিয়ে মাংস দিয়ে ঢেকে দেয়া যেমন একটার পর একটা ঘটে, এখানেও তেমন সিরিজ অফ একশন ঘটে যাচ্ছিলো সবার অগোচরে, প্রতি মুহূর্তে। ফলাফল, মিলি যে আসলে দিনে রাতে জ্বলন্ত উনুনে ফুটছিলো, বাইরে থেকে দেখে কারো তেমন বোঝার উপায় ছিলো না। এমনকি মিলি নিজেও বুঝে নাই, ওর ধারণা ছিলো এটাই মাতৃত্ব। এই না হলে মা?
ডাক্তাররা প্রথম যা করলেন, ওকে হাসপাতালে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পড়িয়ে রেখে দিলেন। কারণ জাগ্রত মিলিকে কোনোভাবেই মানানো যাচ্ছিলো না যে তার বাচ্চা তার চোখের আড়াল হবে। একটা প্যানেল অফ ডাক্তার এরপর বসলেন শোয়েবের সাথে।
তাকে কিছু প্রশ্ন করা হলো । প্রশ্নগুলোর মধ্যে কিছু প্রশ্ন এমন -
- তোমার স্ত্রীর মধ্যে সাম্প্রতিক কোন কোন পরিবর্তন লক্ষ করার মতো?
শোয়েব ভাবতে লাগলো, আসলে মিলিকে তো আর আগের মতো পায়ই না সে। ওর মধ্যে কি পরিবর্তন .. হম ... ওই তো মা হলে যা যা হয় আর কি। শোয়েবের সংক্ষিপ্ত উত্তর ।
ডাক্তার এবার বললেন, একটা একটা করে বলো।
- এই, দিন রাত বাচ্চা নিয়ে পড়ে থাকে। খুব যত্ন করে বাচ্চার। পরিবর্তন বলতে ঘুমায় কম। মেজাজ খিটখিটে থাকে দেখি প্রায় ই আজকাল। কোথাও গেলেও বসতে চায় না। বাচ্চা কাঁদলেই বাসায় ফিরে আসতে চায়। কিন্তু এটা তো স্বাভাবিক। বাচ্চা হলে তো এমন একটু আধটু হয় ই। বাচ্চার মায়ের কি আর দিন রাত আছে?
- তোমার বাচ্চার কি কি কাজ তুমি করো?
- আমি? চোখ কপালে তুললো শোয়েব! আমি বাচ্চার কি কাজ করবো? ছোট বাচ্চা, তার মা ই সব জানে, করে। আর তাছাড়া আমি কিছু করতে গেলে সেটা মিলির মন মতো না, তখন আরো ঝগড়া বাঁধে। তাই আমিও আর কিছু বলিনা।
- অর্থাৎ তোমার স্ত্রী তোমার বাচ্চার প্রাইমারী কেয়ারার এবং ওনলি কেয়ারার। এবং তোমার হওয়ার কথা বাচ্চার সেকেন্ডারি কেয়ারার কিন্তু তুমি তা নও। ঠিক?
- ঠিক, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শোয়েব উত্তর দিলো।
এবার খুব শান্ত মাথায় ডাক্তার বললেন, তোমার বাচ্চা নিয়ে এখন তুমি বাসায় যাও। আগামী চার সপ্তাহ তোমার স্ত্রী ভর্তি থাকবে। বেলা ১০ টা থেকে দুপুর ২ টা, এই চার ঘন্টা তুমি বাচ্চা নিয়ে তোমার স্ত্রীকে ভিজিট করতে পারবে। চার সপ্তাহ পরে তোমার স্ত্রীকে আমরা আবার এসেসমেন্ট করবো এবং সিদ্ধান্ত নেবো ওর কাছে আমরা বাচ্চা দেবো কি না। এর মধ্যে বাচ্চা পালনে তোমার কোনো সহায়তার প্রয়োজন হলে তুমি বেবী ব্লু বুকের ফ্যামিলি এন্ড নার্সেস ইনটেক লাইনে ফোন করে সাহায্য নেবে। আর তোমার সাথে আমাদের নেক্সট এপয়েন্টমেন্ট দিলাম সামনের সপ্তাহে। যাও, বাসায় যাও।
শোয়েবের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
চার সপ্তাহ পরের ঘটনা : মিলির অবস্থা কিছুটা ভালো। তাই তাকে রিলিজ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাচ্চা একা মিলির হাতে এখনো দেয়া হবে না। তাই শোয়েব অফিসে গেলে অন্য কাউকে বাসায় থাকতে হবে হাসপাতাল থেকে এই শর্ত দেয়া হয়েছে। মিলির মা কে দেশ থেকে আনা হলো জরুরি ভিত্তিতে।
৩ মাস পরের ঘটনা: শোয়েব আর মিলির জীবনটা এখন অনেকটাই ছন্দ ফিরে পেয়েছে। মিলি আশেপাশে না থাকলেও শোয়েব বাচ্চাকে দেখাশোনা করতে পারে এখন। বাচ্চা তাই বাবা মা দুজনেরই সমান ভক্ত। বাবার সাথে চলে তার সব প্রিয় খেলা আর মার সাথে আহ্লাদ। কোথাও বেড়াতে গেলে মিলি প্রাণ খুলে দু দন্ড গল্প করে, শোয়েব বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখে অনায়াসে। খুব সহসাই ওরা আরেকটি বাচ্চা চায়। দুজন ই এখন গর্ব করে বলে বেড়ায়, আমরা দুজন ১০ টা বাচ্চাও মানুষ করতে পারবো!
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সেশন কাউন্সেলিং হয়েছে ওদের। মিলিকে যেমন বোঝানো হয়েছে, বাচ্চাকে সারাক্ষন আগলে রাখার কিছু নেই। বাচ্চাটা ওর একার না। ও একা বাচ্চাকে দখল করে বসে থাকাটা একদিকে যেমন ওকে স্ট্রেস এ ফেলে, তেমনি বাবাকেও বঞ্চিত করে বাচ্চার সান্নিধ্য থেকে। বাচ্চা এবং বাবা দুজনেরই অধিকার এতে খর্ব হয়। বাচ্চার প্রাইমারী কেয়ারার অবশ্যই মা। আর বাচ্চার ভালোর জন্যই মায়ের ভালো ও সুস্থ্য থাকা খুব প্রয়োজন। এই ভালো থাকার জন্যই মায়ের ব্রেক দরকার। দরকার বাবার উপর নির্ভর করতে শেখা।
শোয়েবকেও তেমনি বোঝানো হলো, মা প্রাইমারী কেয়ারার হলে বাবাকে অবশ্যই সেকেন্ডারী কেয়ারারের ভূমিকা নিতে হবে। যার অর্থ হচ্ছে মায়ের অবর্তমানে মায়ের মতো না হলেও অন্তত বাচ্চার বেসিক জিনিসগুলো হ্যান্ডেল করতে জানতে হবে। বাচ্চার সাথে আত্মিক যোগাযোগ বা বন্ডিং থাকতে হবে। তার প্রয়োজন বা চাহিদা বুঝতে হবে।
প্রিয় পাঠক, ট্রেনে বসে একটা ছোট্ট স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম গত শুক্রবার। বিষয় ছিলো একটা মায়ের একটু একান্ত সময় কাটানোর ঘটনা। সেই একান্ত সময় কাটানোটা বাচ্চাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে ধেই ধেই করে নাচতে যাওয়ার ঘটনা ছিলো না, ছিলো না বাচ্চাকে কোনো বিপদে ঠেলে দিয়ে ফূর্তি করার ব্যাপার। আমার আপনার মতোই রক্ত মাংসের একটা মমতাময়ী মা বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে হাস্যোজ্জ্বল বাবার কোলে ওকে দিয়ে বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। আমি নিশ্চিত এবং বাজি ধরে বলতে পারি ওই দম্পতি সুখী এবং মায়ের এই বেড়াতে যাওয়াতে বাবার পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিলো।
স্টাটাসটিতে প্রায় ৫ হাজারের মতো সমর্থনের বিপরীতে কিছু তীর্যক বক্তব্য এসেছে। অনেকে তো আমার মাতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন পাশ্চাত্য জীবন ব্যবস্থা নিয়ে! কি অদ্ভুত! কি নোংরা ব্যাপার ! আমার নিজের মনে আছে আমাদের সব কাজিনদেরকে নানুর কাছে রেখে আম্মু খালারা ক্লাস করতে গেছেন, মার্কেটে গেছেন! কৈ, সেখানে তো কথা ওঠে নাই! আর এইখানে ভদ্রমহিলা বাচ্চার বাবার কাছে বাচ্চা রেখে গেছেন বলে এমন সব কমেন্ট আসলো যা পড়ার পর উত্তর দিতেও রুচিতে বাঁধে! এদের কাউকেই ব্লক করিনি, কমেন্ট গুলোও ডিলিট করিনি। কারণ এরা সমাজেরই অংশ।
যেসব মা খুব জোর গলায় বলছেন " আমার বাচ্চাকে আমি এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করি না বা ওকে রেখে আমি জীবনেও এক মুহূর্ত কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না", জেনে রেখেন, দ্যাট ডাস নট মেইক ইউ এনি বেটার মাদার এট অল। আপনি আপনার বাচ্চা ও তার বাবাকে তাদের মধ্যে আত্মিক যোগাযোগ গড়ার সুযোগটা কমিয়ে দিচ্ছেন। এই বাচ্চার ভালো মন্দের সাথে যুক্ত হওয়া তার বাবার জন্য দিন কে দিন কঠিন হবে। বাচ্চার দুজনকেই প্রয়োজন। এবং দুজনেরই বাচ্চাকে জানা প্রয়োজন খুব ভালো ভাবে। সেটার শুরু ডে ওয়ান থেকেই হতে হয়। বাচ্চার প্রাইমারী কেয়ারার মা থাকবেন অবশ্যই কিন্তু সেকেন্ডারি কেয়ারারের ভূমিকাটা হবে বাবার এবং সেই সুযোগটা আপনি খুব উচ্চমার্গের আঁতলামি করে নষ্ট করছেন তিলে তিলে। আপনি স্বার্থপর এবং ঠিক মিলির মতোই, আপনার নিজের রোগ বুঝার ক্ষমতা আপনার নিজেরও নাই।
আর পিতৃত্ব বা ফাদারহুড বলে যে একটা টার্ম আছে, ঐটা সচেতনে, অবচেতনে, মনে- মননে, কর্মে-ধর্মে শোয়েবের মতো ইগ্নোর আর ডিক্লাইন করা বাবা রা, যারা সুচতুর ভাবে এই ধারণা নিয়ে বসে আছেন যে মা হয়ে গেছে যেই মহিলা, তার বাইরের কোনো জগৎ থাকতে নেই, যদি থাকে তো সে বিশ্ব নষ্টা, তার মা হওয়ার কোনো অধিকার নেই ... তার সন্তান ঐশী হবে .. পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কুফল আমার সংসারে ঢুকতে দেয়া যাবে না, সেই বাবা রা যারা বাইরে থেকে কাজ শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডবাজি করে বাসায় ফিরে টিভির রিমোট আর ফেসবুকে দুনিয়া উদ্ধার করে নাক ডেকে ঘুমাবেন আর মগজে লালন করবেন বাচ্চার কাঁথা কাপড় দুধের বোতল কান্নাকাটি?? ওইসব পুরুষমানুষের কাজ নাকি? ওইসব ২৪/৭ মায়ের কাজ .....তাদের বলি -
ইউ আসহোলস আর জাস্ট গড ড্যাম "স্পার্ম ডোনার্স"। কলিং ইউ গাইস "ফাদার" ইস জাস্ট নট মাই কাপ অফ টি।
ফাদার হবেন না স্পার্ম ডোনার.. সিদ্ধান্ত আপনার ... !
No comments:
Post a Comment